৬০ বছরে কি পেলাম আর কি হারালাম,
লেখক: ড. আব্বাস ভূঁইয়া।
অধ্যায় (৯):
ষাটের দশকে আমার গ্রাম কাশিমপুরই ছিল আমার দেশ, আমার পৃথিবী। পিছনে ফিরে তাকালে এখনকার কাশিমপুর তখন আমি স্বপ্নেও দেখতাম না।
গত ৬০ বছরে কাশিমপুরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের বর্ননা, সহায়ক শক্তিসমূহ ও ভবিষ্যত নিয়ে আমার এই প্রয়াস। ধারাবাহিকভাবে চলবে।
৬০ বছরে কি পেলাম আর কি হারালাম।
স্বাস্থ্য:
দেশে মানুষের গড়পড়তা আয়ু অনেক বেড়েছে। কাশিমপুরেও। গোরস্হান গুলিতে তেমন নতুন কবর দেখা যায়না। গ্রামবাসীদের মধ্যে বয়স্ক লোকজন আগের থেকে বেশী।
কুকুরের কামড়ের চিকিৎসায় ময়নামতির পুরিন্দা আর কসবা অঞ্চলের ফু দেওয়া থালা হারিয়ে গেছে। এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় হাজারো রকম ওষুধ এসেছে। গিয়েছে সেই লালচে তরল মিকচার। যেমনটি হারিয়ে গেছে রবীন্দ্র ডাক্তার ও হরিপদ ডাক্তার। জায়গা করে নিয়েছে এমবিবিএস ও প্যারাপ্রফেশনালরা। সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও দশ মাইলের মধ্যে অনেক প্রাইভেট চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। প্রয়োজনে ঢাকায় যাওয়া সহজ।
এখন ঔষধের প্যাকেটে লেখা ডোজ। প্রেসক্রিপশনে ও। মিকচারের বোতলে খাচঁকাঠা কাগজের লেবেল নিরবে সরে গেছে।
সরকারি বেসরকারী কর্মকান্ডের ফলে স্বাস্হ্যসচেনতা বেড়েছে। পেটের গন্ডগোল ভাল করতে পুরানো নাভি তোলা আর পানপাতার ডিড পুড়া এখন স্মৃতিতে ও বিলুপ্ত। বিজ্ঞানভিত্তিক খাবার স্যালাইনের ব্যবহার সার্বজনিন হয়েছে। পথ্য হিসাবে রবিনসন বার্লি, সাগু কদর হারিয়েছে। সেই বোতলে রাখা ফু দেওয়া শেওলা পড়া পানি আর এখন নেই।
চোখলাগা থেকে বাচার জন্য এখন কাউকে এড়িয়ে বাচ্ছাদের খাওয়াতে হচ্ছে না। এমন আরো অগনতি অবিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকলাপ বিদায় নিয়েছে।
লোকজন এখন আগে না শোনা অনেক রোগে ভুগছে। ডায়াবেটিস, ব্লডপ্রেসার আরো কত কি! আর্থিক অবস্হার উন্নতিতে যখন কাশিমপুরের লোকজন একটু আধটু আরাম আয়েস করা শুরু করেছে তখন ডাক্তাররা বলছে বেশী করে হাটতে। পোলাও, বিরানী আর চিকন সাদা চালের ভাত খাওয়া কমিয়ে লাল আকাড়া চালের ভাত খেতে!
শিক্ষা:
পড়তে লিখতে পারেনা এমন পুরুষ মহিলা ছেলেমেয়ে এখন খুজে পাওয়া যাবেনা। শহর থেকে লেখা স্বামীর চিঠি পড়তে ও উত্তর লিখে দিতে এখন আর গ্রামের লেখাপড়া করা ছেলেটাকে কেউ খুজে না। মুহররমের সময় বিষাদসিন্ধু পড়ার ব্যাপারেও একই ঘটনা। পড়তে না পারাটা আগেকার। হয়ত বিষাদসিন্ধু পড়াও।
মেট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য মেরাশানী হাইস্কুলের শিক্ষকদের স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে স্কুল সময়ের বাইরে পড়ানো আর নেই। জায়গা করে নিয়েছে প্রাইভেট কোচিং।
গ্রামের রাস্তায় ইউনিফরমে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য যোগ হয়েছে। ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে শহরে ও বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
মোবাইল ফোন:
মোবাইল ফোন সবার হাতে। সবাই নাম খুজেঁ টেলিফোন করতে পারছে। পরিচিত কারো কাছ থেকে ফোন এলে নাম ধরে হেলু বলতে পারছে।
স্মার্টফোন আরেক মাত্রা যোগ করেছে। যে যত দূরেই থাকুক ফেসবুকে আত্মীয়স্বজনের ছবি দেখতে পারছে। ভিডিও কল ও। ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পারছে। এমন কি সিনেমাও। রান্নার বইয়ের কদর কমেছে। গান শুনার টু ইন ওয়ানের সমাধি হয়েছে। ছবি তুলতে স্টুডিও তে যাওয়া বন্ধ হয়েছে।
ষাটের দশকে কাশিমপুরে দুইটা কলের গান (গ্রামোফোন) ছিল। এরমধ্যে একজনকে অন্যরা খাওয়ার দাওয়াত করত কলের গান সহ। গান শোনার জন্য। এ এখন শুধুই স্মৃতি।
সমাজ:
কাশিমপুরে মানুষ এখন অনেক আত্মনির্ভর, আত্মকেন্দ্রিক। যে যার মত জীবনযাপন করে। একে অপরের উপর নির্ভরতা অনেক কমেছে। তাই সামাজিক বন্ধন আগের থেকে ভিন্ন রুপ নিয়েছে।
বদলা শ্রম দিয়ে এখন পরস্পরের জমি চাষ, ধান রোয়া ও কাটা নিছক সেকেলে গল্প। কারো লেখাপড়ার জন্য গ্রামবাসি মিলে দুরদুরান্তে গিয়ে ঘর বেধে দিয়ে আসা শুধুই মধুময় স্মৃতি।
বৈশাখের প্রথমদিন সানকিতে ঘটাকরে পান্তাভাত আর পুড়ামরিচ কচলিয়ে খাওয়া এখন যেমন শহরে রেওয়াজ তেমনি কাশিমপুরেও। প্রত্যেকদিন সকালের নাস্তায় রাতের বেচে যাওয়া পানি দেওয়া ভাত, পুড়ামরিচ আর সিদলের ভর্তা এখন গরম ভাত, আটার রুটি আর ডিম ভাজা বা তরকারিকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
মুহররম মাসে একজন বাশ দিয়ে তাজিয়া (ঘোড়া) বানাত। যা মহরমের দিন কাধে করে মিছিল করত। হায় হোসেন, হায় হোসেন বলে বিলাপ করে করে খরমপুরে নিয়ে যেত। সন্ধ্যায় ফেরত এসে উত্তরে মোড়াতে একটা ঘরে রেখে দিত। এর চর্চা এখন সম্ভবত নাই।
কাশিমপুর আজাদ ক্লাবের কথা এখন আর তেমন শুনা যায়না। অনুষ্টানাদিতে বাসনকোসন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসাদি ও খাবারের জন্য ক্যাটারার ও ডেকোরেটর আছে। এমনকি মহিলাদের সাজগোজের জন্য বিউটিশিয়ানদের হোম সার্ভিস ও আছে।
ঈদে এখনো শহর থেকে গ্রামে যাওয়া অব্যাহত আছে। এইটা অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসে কর্মরতরাও আসতে চেষ্টা করে। অনেকেই শহর অঞ্চলে বাড়িঘর করে স্হায়ী হয়েছে। তাদের কেউ কেউ আসে। কেউ কেউ আসেনা।
কাশিমপুর এখন অনেকটা শহরে সমাজ। বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শহরজীবন যতটা গ্রামীন সমাজের সম্প্রসারণ, বতর্মান কাশিমপুর যেন ততটা শহর জীবনের গ্রামীন সংস্করণ।