নিজস্ব প্রতিবেদক:
শুক্রবার রাতে জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার ঘোষণায় কুমিল্লা থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার সব যাত্রীবাহী বাসের ভাড়া বাড়িয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। হঠাৎ ভাড়া বাড়ার প্রতিবাদে বাসস্ট্যান্ডজুড়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন সাধারণ যাত্রীরা।
শনিবার সকাল ১০টায় নগরীর শাসনগাছা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় কুমিল্লা থেকে ঢাকার ভাড়া আদায় করা হচ্ছে আড়াই শ টাকা। গত শুক্রবার পর্যন্ত শাসনগাছা থেকে ঢাকাগামী তিশা ও এশিয়া পরিবহনের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা।
নগরীর জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, বাসগুলো ডিজেলে চলে। প্রতি লিটার ডিজেল ৩৪ টাকা বেড়ে যাওয়ায় এশিয়া এয়ারকন যাত্রীপ্রতি ৩০০ টাকা করে নিচ্ছে। তাদের আগের ভাড়া ছিল আড়াই শ টাকা।
এশিয়া এয়ারকনের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই। তেলের দাম বাড়লে বাস ভাড়াও বাড়াতে হয়। আমরা তো আর ভর্তুকি দিয়ে বাস চালাতে পারি না।’
খবর নিয়ে জানা গেছে, শনিবার থেকেই কুমিল্লা-চাঁদপুর রুটে ৪০ টাকার ওপরে বাস ভাড়া বাড়তে পারে।
এদিকে তেলের দাম বাড়ায় প্রায় বন্ধ রয়েছে প্রিন্স সৌদিয়ায় বাস চলাচল। প্রিন্স সৌদিয়ার ম্যানেজার টিপু সুলতান বলেন, ‘আগে আমরা কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের ভাড়া নিতাম ২৬০ টাকা। শনিবার সকাল থেকে ৩০০ টাকা করে নিচ্ছি। সকাল থেকে আমাদের ১০টা গাড়ি ছেড়ে গেছে। তবে চট্টগ্রামে আন্দোলনের ফলে চট্টগ্রাম থেকে বাস আসতে পারছে না।’
বাস সংকট ও ভাড়া বাড়ার ঘটনায় বিপাকে পড়েছেন অনেক যাত্রী। জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, অনেকেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন।
বাস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত চট্টগ্রাম কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী কাজী নাজিয়া আক্তার বলেন, ‘সকাল ১০টায় এসেছি বাসস্ট্যান্ডে। এখনও কোনো বাস পাচ্ছি না। আমার মতো আরও অনেকেই এই সমস্যায় পড়েছেন।’
কক্সবাজারে চাকরি করা আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘একদিকে ভাড়া বেড়েছে। অন্যদিকে বাস নেই। বড় ঝামেলায় আছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কয়েকটি পরিবহনের বাস ভাড়া বাড়ালেও বাসের সংখ্যা খুবই কম। শহরের পৈরতলা ও ভাদুঘর বাস টার্মিনাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বাসের ভাড়া বেশি নেয়ার বিষয়ে তিশা বাসের কাউন্টার মাস্টার জানিয়েছেন, মালিকপক্ষের নির্দেশেই তারা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন।
তিশা বাসের কাউন্টার ম্যানেজার জানান, ঢাকাগামী তিশা বাসের নরমাল সিটের ভাড়া ২৫০ টাকা, সেটি এখন বাড়িয়ে ৩০০ টাকা এবং এসি সিটের আগের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা, তা এখন ৩৫০ টাকা করা হয়েছে।
তবে পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত না থাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চট্টগ্রামগামী অনেক অনেক বাসের ভাড়া এখনও বাড়ানো হয়নি বলে জানিয়েছেন আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির কার্যালয়ে দায়িত্ব থাকা মো. বাবুল মিয়া।
এদিকে, সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চট্টগ্রামের বাস বন্ধ ছিল বলে জানান পরিবহন মালিকরা। এতে দুর্ভোগে পড়েন বেশ কিছু যাত্রী।
নেত্রকোণা: তেলের দাম বাড়ায় নেত্রকোণার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব রুটেই বাসাভাড়া বেড়েছে। চলাচলরত বাসের সংখ্যাও অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এতে বাসের বিকল্প হিসেবে ট্রেন, সিএনজিসহ অন্যান্য গণপরিবহনের ওপর চাপ বেড়েছে।
নেত্রকোণা বাস মালিক সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, সরকার এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় তারা কোনো বাসভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেননি। তবে চালক ও শ্রমিকরা রুটভেদে ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন।
সরেজমিনে নেত্রকোণার আন্তঃ জেলা বাসস্ট্যান্ড, রাজুরবাজার বাসস্ট্যান্ড ও বনোয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ভাড়া বেশি নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ডে নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ রুটের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, টিকিট বিক্রেতা জুয়েল মিয়া পূর্ব নিধারিত ৬৫ টাকার বদলে ৮০ টাকা করে টিকিটি বিক্রি করছেন। অন্যদিকে, নেত্রকোণা-ঢাকা রুটের কাউন্টারে টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকার বদলে ৩৫০ টাকায়।
এ ছাড়া রাজুরবাজার বাসস্ট্যান্ডে নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা-কলমাকান্দা রুটের এবং বনোয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেত্রকোণা-মদন রুটের বাস ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা করে বেশি নেয়া হচ্ছে।
বাস ভাড়া বাড়ানোর ফলে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা হতেও দেখা গেছে। আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ডের শাহজালাল ও মহুয়া কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক যাত্রীই টিকিট বিক্রেতার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছেন।
মিলন কুমার দাস নামে পঞ্চগড় থেকে নেত্রকোণায় আসা এক যাত্রী অভিযোগ করেন, ‘গাজীপুর থেকে নেত্রকোণায় আসতে আমার কাছ থেকে ৩৮০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। অর্থাৎ ৮০ টাকা বেশি নিয়েছে। এটা ডিজেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।’
এদিকে বাসভাড়া বাড়ানোর ফলে সিএনজি, ট্রেন, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গণপরিবহনের ওপর চাপ বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বাসের বদলে অনেকে সিএনজি বা মোটরসাইকেলে চলাচল করছেন। এ অবস্থায় সিএনজি ভাড়াও ২০ টাকা করে বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
রংপুর: রংপুর থেকেও ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দূরপাল্লার সব বাসের ভাড়া বেড়েছে। শনিবার সকাল থেকেই এসি বাসে ২০০ আর নন এসি বাসে আপাতত ৪০ টাকা বাড়িয়েছেন তারা।
ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বাস কাউন্টারে ম্যানেজাররা।
টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, বাসের ভাড়া বাড়ানোর ফলে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ।
ঢাকাগামী যাত্রী সীমা বলেন, ‘আমি আগামীকাল ঢাকা যাবো। এ জন্য এসআর ট্রাভেলসে এসির টিকিট নিলাম। ভাড়া নিল ১৫০০ টাকা। কাউন্টার থেকে বলছে তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ভাড়া বেশি নিচ্ছে।’
যাত্রী ফরহাদ হোসেন সমুন বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টারে গেছি। সবাই ভাড়া বাড়িয়েছে। ফতেহ আলী পরিবহণে ৪০ টাকা বেশিতে টিকিট নিলাম।’
আজিজুল ইসলাম নামে এক যাত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘কার কাছে অভিযোগ বা কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো? করার কিছু নাই। যা আদেশ হবে তাই মানতে হবে। তবে, এভাবে জনগণকে চিপায় ফেলে জিনিসের দাম বাড়ানো উচিৎ নয়।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অভ্যন্তরীণ রুটের পরিবহন মালিকরা বলছেন, বাসের ভাড়াও বাড়ানো হবে। যদিও ভাড়া বাড়ালে তারা যাত্রী সংকটে পড়বেন বলেও আশঙ্কা করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিশ্বরোড মোড়ে রহনপুর ও নাচোল রুটে চলাচল করা বাসেরস্ট্যান্ডে দেখা যায়, পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের ডাকছেন টিকিট কেনার জন্য।
২৪ বছর থেকে গাড়ি চালাচ্ছেন মোহাম্মদ রাজু নামে এক চালক। তিনি জানান, ‘যে গাড়িটার তেল লাগতো ১৭৫০ টাকার, সেটির এখন লাগবে ২৫১০ টাকার তেল। ছোট গাড়িগুলোর জন্য আমরা তো এমনিতেই যাত্রী পাই না। ভাড়া বাড়ালে তো আরও যাত্রী পাবো না।’
এ অবস্থায় জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, তেলের দাম বাড়লেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী ও অন্যান্য জেলাগামী বাসগুলোতে আগের ভাড়াই রাখতে দেখা গেছে। তবে কিছুটা শিপিউল বিপর্যয় ছিল। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোববার থেকে বাসের ভাড়া না বাড়ানো হলে তারা আর বাস চালাতে পারবেন না।
সাভার: ঢাকার সাভারে বিভিন্ন রুটের গণপরিবহনগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। ভাড়া নিয়ে বাসের স্টাফদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কও করছেন তারা। অন্যদিকে সিন্ডিকেট করে সড়কে বাসের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ।
শনিবার সকাল থেকে সাভারের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত যাত্রীরা কোথাও দ্বিগুণ আবার কোথাও তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায়ের কথাও জানিয়েছেন।
ধামরাইয়ের বাসিন্দা সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী লাকী আক্তার বলেন, ‘আমি গণবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ধামরাইয়ের জয়পুরা থেকে সাভারের বাইশমাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপরিবহনেই যাতায়াত করি। গতকাল জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর আজ বাসে ভাড়া দিতে গিয়ে বাসের লোকদের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। ১০ টাকার ভাড়া যাত্রীসেবা নামের বাসের কন্টাক্টর ৩০ টাকা চাচ্ছে। পরে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ২০ টাকা দিয়েছি। এভাবে তিন গুণ বেশি ভাড়া হলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিভাবে চলাচল করব?’
এই রুটের তাসনুভা তাবাসুম নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘সাভারের রেডিওকলোনী থেকে ধামরাই গিয়েছি সকালে ডি লিংক পরিবহনের বাসে। ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা চাইছে। অনেক চিল্লাপাল্লা করে ১৫ টাকা দিয়েছি। তা ছাড়া অন্য দিনের তুলনায় আজ রাস্তায় বাস অনেক কম। ফলে বাসের জন্য অনেক্সণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।’
আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল এলাকাতেও বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
এ সব অভিযোগ নিয়ে সাভার পরিবহনের বাসচালক নাদিম বলেন, ‘তেলের দাম বাড়লে আমরা কি করুম? আমরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়ার কথা বলে যাত্রী তুলছি।’
আশুলিয়া এক্সপ্রেস পরিবহনের পরিচালক জিএম মিন্টু বলেন, ‘এখনও ভাড়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি। রাতে মালিক সমিতির বৈঠক আছে। সেখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কিছু ড্রাইভার নিজেদের মতো করে গাড়ি রোডে নামিয়ে চালাচ্ছে।’