সিয়াম, ঢাকা:
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও দোসরদের নির্যাতনে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে বাংলাদেশ ভুক্তভোগী হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে শনিবার বাংলাদেশ ইউনাইটেড নেশনস মাইগ্রেশন নেটওয়ার্ক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় পরামর্শক সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘মানব পাচার বিষয়ে বাংলাদেশ আজ পরিস্থিতির শিকার। বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের কারণে ভিকটিম (ভুক্তভোগী) হয়ে গেছে।
‘আমাদের সম্পদ সীমিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও সহায়তা নিশ্চিত করছে, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, এই বাস্তুচ্যুত নাগরিকরা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ তাই দ্রুতই মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চায়।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার সূচকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান করছে। এটি বাংলাদেশের প্রতিনিয়ত মানব পাচারের বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রতিফলন। মানব পাচার ইস্যুকে আমাদের সরকার ও প্রচলিত আইন গুরুত্ব দিয়ে দেখে।’
দিবসটি উদযাপন নিয়ে কামাল বলেন, ‘প্রথমবারের মতো এই দিনটি উদযাপনের অর্থই হচ্ছে মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। এই অপরাধ রোধে সরকার আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
‘সম্প্রতি ফেসবুক ও টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানব পাচার বেড়েছে। বিশেষ করে মহামারি করোনাকালে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মানব পাচার রোধে পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে মানব পাচার রোধে এগিয়ে আসতে হবে।’
বৈধ মাইগ্রেশনের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘প্রযুক্তি একটি অস্ত্র। এর মাধ্যমে জীবন যেমন রক্ষা করা যায়, তেমনি হত্যাও করা যায়। এই অস্ত্র এখন মানব পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে মানব পাচারকারীরা আরও বেশি ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম। সরকার এবং অংশীজনরা প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, মানব পাচার একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম এবং আমাদের থেকে অন্য দেশের প্রযুক্তি আরও উন্নত হতে পারে, মানব পাচারকারীরা যার সুবিধা নিতে পারে। সে জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন উন্নত প্রযুক্তি হাতে পাওয়ার সুবিধা পায়।’
মোমেন বলেন, ‘সরকার নাগরিকদের মানব পাচারের শিকার হওয়া থেকে বিরত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে আমাদের উদ্যোগ ও প্রণীত নীতি তা-ই ইঙ্গিত করে। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে আমরা বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছি, তবে এটা ঠেকাতে উন্নত দেশগুলোতে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে।
‘তৃতীয় বিশ্বেও কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে মাইগ্রেশন কিন্তু অবৈধ না। মাইগ্র্যান্টরা হোস্ট কান্ট্রির (যে দেশে যান) অর্থনীতি, জিডিপি ও কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই বৈধ মাইগ্রেশনের ক্ষেত্র উন্নত বিশ্বকে উন্মুক্ত করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ইমিগ্র্যান্টদের (অভিবাসী) দেশ বলা হয় এবং ইমিগ্র্যান্টরা সেখানে বোঝা নয়। ইমিগ্র্যান্টরা দেশটির ইনোভেশন (উদ্ভাবন) ও উন্নয়নের উৎস। তারা স্থানীয়দের কর্মসংস্থান কমিয়ে না এনে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। আমরা যদি মানবিক বোধের জায়গা থেকে একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে এ সংকট থেকে উত্তরণ করতে পারব।’
রোহিঙ্গাদের নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের পাচার রোধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমাদের অনুরোধে তা করা যায়নি।’
অনুষ্ঠানে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আকতার হোসেন বলেন, ‘পাচারকারীরা প্রতিনিয়তই তাদের নীতি, কৌশল ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে। এ জন্য তারা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। তাদের ঠেকানো বা প্রতিরোধের জন্য প্রযুক্তিকেই ব্যবহার করতে হবে।’
জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি জিন লুইস বলেন, ‘জাতিসংঘ অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশকে মানবপাচার প্রতিরোধে সহায়তা করে আসছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের ভারপ্রাপ্ত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জেরেমি অপরিটসো জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানব পাচারকে সব সময়ই ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে দেখে। কেননা এর মাধ্যমে একটা বৈশ্বিক অপরাধ হয়। বাংলাদেশের নারী-শিশুরাও পাচারের শিকার হচ্ছে।
ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যেখানে মানবপাচারের মতো অপরাধের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। এর শিকার এ দেশের অনেক মানুষ। এর মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। ভালো খবর হলো বাংলাদেশ সরকার ও এ দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অফ মিশন স্কট ব্র্যান্ডন, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চর্ড, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের চিফ অফ মিশন আব্দুসসাত্তর ইজয়েভ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনসহ অনেকে।