বাংলাদেশের ১৬কোটি মানুষের প্রত্যেকেরই আছে আলাদা আলাদা স্বপ্ন। আশা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ। যদি মানুষের এই আশা না থাকত, তাহলে বেচে থাকার যৌক্তিকতা থাকত না। কবি গুরুর ভাষায়, “আশাহীন শ্রান্ত আশা টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ কুয়াশা।”
সকলের সব আশা পুরণ হয় না, তবুও মানুষ আশা করে ও স্বপ্নের জাল বুনে।তেমনি স্বপ্ন দেখছে গৃহহীন শ্রমিক, পথশিশু মেহেদী হাসান।
মেহেদীরও আছে স্বপ্ন, আছে বড় হওয়ার বাসনা। কিন্তু অন্যান্য আট দশটা মানুষের মত তার স্বপ্নের পথ খুব একটা মসৃণ না।
জন্মের পর মেহেদী এবং তার মা কে রেখে চলে যান তার বাবা। বয়স যখন ছয় বছর তার মা মারা যায়। তখন সে লঞ্চে করে বরিশাল থেকে চলে আসে ঢাকা। একবেলা খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছে সমগ্র সদরঘাট এলাকা। বিভিন্ন দোকানে ঘুরেছে একটা কাজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও সেই সুযোগ মিলল না। তখন বাধ্য হয়ে শুরু করেন ভিক্ষা বৃত্তি! রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে আর মানুষের কাছে চেয়ে খাবারের জোগাড় করেছে। ঘুরে ঘুরে তার সমবয়সী অনেকের সাথে পরিচয় হয়। তাদের সাথেই বসবাসের ঠিকানা করে নিয়েছে। কখনো পার্কে, কখনো রাস্তায়, কখনো দোকানের সামনে অথবা বড় কোন বিল্ডিংয়ের নিচে রাত্রি যাপন করেছে। সে সমস্ত জায়গায় ঘুমানো খুব একটা সহজ ছিল না। খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছিল, হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কখনো আবার পুলিশ এসে তুলে দেয়, বড় বিল্ডিংয়ের নিচে দারোয়ান এসে তাড়িয়ে দেয়। বছর খানেক এইভাবে কাটানোর পর তার মনে হলো এই ভিক্ষা বৃত্তি খুব অপমানজনক। তখন সে আবার ফিরে আসে সদরঘাটে।অনেক ঘুরাঘুরি করে, একটা কাজের সন্ধ্যান মিলল। সে কাজটা হচ্ছে পুরাতন ও অকেজো লোহা, প্লাস্টিক বিক্রি করা। এখন পর্যন্ত সেই কাজ করেই জীবিকা চালাচ্ছে এবং কাজের বয়স ১১ বছর। ঢাকা শহরে বসবাসের বয়স তার ১২ বছর। দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই দেখেছে, চলাফেরা করেছে অনেক মানুষের সাথে। গত চার বছর যাবত তার থাকার সুন্দর একটা ব্যাবস্থা হয়েছে বলে তার দাবী। আর সেই জায়গা টা হচ্ছে পিলারের নিচের অংশ। সদরঘাটের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য কিছু ব্রিজ স্থাপিত আছে। ব্রিজ দিয়ে ঢুকার সময় গেইটে টাকা দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। টাকা সংগ্রহের জন্য গেইটে পিলার দিয়ে কাউন্টার রুম তৈরি করা আছে।
সেই রুমের নিচেই থাকার জন্য জায়গা করে নিয়েছে মেহেদী, যেখানে অন্তত একটা ছাদ আছে। বৃষ্টি-রোদ থেকে রেহাই মিলে। বৃষ্টি রোদ থেকে রেহাই মিললেও নৌ-পুলিশের কাছে প্রায়ই মারধর খেতে হয়। দিতে হচ্ছে মাঝে মাঝে টাকা। তিন চার হাতের মত জায়গা হবে। সেখানে বাস করে মেহেদী সহ মোট ৬ জন। বাকিরা হল মারুফ, খোকা, রণি, কবির, রাজা। তাদের কারো বয়স ১০ বছরের বেশি হবে না। একমাত্র মেহেদীর বয়স ই ১৮ বছর।
ছোট্ট একটা জায়গায় সে একা থাকলেও ত পারত, এমন প্রশ্নের জবাবে মেহেদী বলে,”এখন তাদের যে বয়স, সে বয়সেই আমি ঢাকা এসেছিলাম। ঢাকা শহরে একটা মাথা গুজার জায়গা পাওয়া কতটা কষ্টের তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করার জন্য, বিভিন্ন স্কুলে ঘুরেছি। স্কুলে যখন দেখতাম আমার বয়সের বাচ্চাদের তাদের মা/বাবা স্কুলে নিয়ে আসছে হাতে ধরে, তাদের কিনে দিচ্ছে বিভিন্ন রকম খাবারের জিনিস। তখন আমি ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম বাবা আসলে কেমন হয়? তারা যখন গাড়ি থেকে নামত তখন ভাবতাম আমারও তো হাত, পা, চোখ, মুখ, পেট আছে তাদের মত। তারা কি সুন্দর গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করে, অথচ আমার বেলা ঘুমানোর একটা জায়গা হয় না এই শহরে। বিছানা, বালিশ কিছুই ত চাহিদা ছিল না আমার। হাতের উপর মাথা দিয়ে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলাম।
সেই অপ্রাপ্তি থেকে আমার একটা স্বপ্ন আছে, আমি চাই বড় একটা বিল্ডিং বানিয়ে আমার মত যারা রাস্তায় ঘুমায় তাদের একটা ছাদের নিচে ঘুমানোর সু্যোগ করে দেওয়া। এই যে দেখুন অল্প একটু জায়গা! এখানেই কিন্তু আমরা ছয়জন থাকতে পারছি। তাইলে চিন্তা করেন, বড় একটা বিল্ডিংয়ে আমরা কত মানুষ থাকতে পারব?
খেয়াল করে দেখলাম তাদের ঘুমানোর জায়গা বেশ গুছানো, একটা এলার্ম ঘড়ি লাগানো আছে। আর দেওয়ালে লেখা, ভাই সকাল হয়েছে।হয়ত কোন অজানা কারণেই এই লিখা লিখেছে।
তবে তার সুন্দর চিন্তাগুলো শুনে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবনার উদ্রেক হয়েছিল, সত্যিই যদি তাদের কষ্টের জীবনের অন্ধকার কাটিয়ে সকালের সোনালী সূর্য্য দেখা দিত!
জিজ্ঞেস করলাম এই পেশায় কেমন লাগে? সে মৃদু হেসে উত্তর করল, মানুষ যখন আমাকে টোকাই বলে ডাকে শুনতে আমার একটুও কষ্ট লাগে না। অন্তত ভিক্ষা করার সময় নিজে নিজে যতটা কষ্ট পেতাম, সেই কষ্টটা এখন আর পাই না। তাছাড়া ময়লা- আবর্জনা, বোতলগুলো যখন আমাদের ব্যাগে কুড়িয়ে নেই তখন দেখি আগের চাইতে আশেপাশের জায়গা টা সুন্দর হয়েছে। মনে মনে শান্তনা পাই এই ভেবে যে, দেশ পরিষ্কার করার জন্য কাজ করছি। তাছাড়া সারাদিনে যা সংগ্রহ করি, সেগুলো মহাজন সানি গাজীর কাছে বিক্রি করে ভালই টাকা ইনকাম হয়।
এ বয়সে ওদের কেউ মায়ের কোলে, কেউ স্কুলে থাকতে পারত। থাকতে পারত পরিবারের অটুট বন্ধনে। কিন্তু নিয়তির ফেরে এসব কিছুই পাওয়া হয় না ওদের। ওরা রাস্তায় ঘুমায়। পথে পথে ঘোরে। ক্ষুধার দায়ে রাস্তায়ই বেছে নেয় জীবিকার পথ। ওরা টোকাই, ওরা ছিন্নমূল পথশিশু। তবে তাদের স্বপ্নটা ছোট না। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ও বন্ধুপ্রেমে অকৃত্রিম।