ফয়সাল আরেফিন, পঞ্চগড়:
পঞ্চগড়ে গত কয়েক মাস ধরে চলা সার সংকট আমনের ভরা মৌসুমে এসে চরম আকার ধারণ করেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
তাদের অভিযোগ, ডিলারদের গুদামে সার পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প কিছু জনসমক্ষে বিতরণ করা হলেও তা জুটছে না সবার ভাগ্যে। গুদাম থেকে সার পাওয়া না গেলেও গোপনে বেশি দামে চলছে বেচাকেনা।
ডিলারদের দাবি, তারা যা বরাদ্দ পাচ্ছেন, তা সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করা হচ্ছে। বাইরে থেকে যারা কিনে এনে বিক্রি করছেন, তারা বেশি দাম নিচ্ছেন।
কৃষি অধিদপ্তর বলছে, বিষয়টি কর্মকর্তারা মনিটর করছেন। কেউ অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলায় আমনের জন্য জমি প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন চাষিরা। অনেকে সেচ দিয়ে ধানের চারা রোপণ করেছেন। এই সময়েই চরম আকার ধারণ করেছে সারসংকট। ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি কোনো সারই পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদামতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বস্তা সারে বেশি নেয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। বাধ্য হয়েই বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের।
চাষিরা বলছেন, ইউরিয়ার সরকার নির্ধারিত মূল্যে বস্তাপ্রতি ৮০০ টাকা, টিএসপির ১ হাজার ১০০ টাকা, এমওপি ৭৫০ টাকা, ডিএপি ৮০০ টাকা হলেও ইউরিয়া ১ হাজার ১০০ টাকা, টিএসপি শ্রেণিভেদে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, এমওপি ১ হাজার ৪০০ টাকা, ডিএপি ১০০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর বাধ্য হয়েই চাষিদের এ দামে সার কিনে জমিতে দিতে হচ্ছে।
প্রতি বিঘা জমিতে ইউরিয়া ৭ কেজি, টিএসপি ১০ কেজি, পটাশ ২০ কেজি, ডিএপি ১৫ কেজি দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পরিমাণমতো তা দিতে পারছেন না অনেকে।
জানা গেছে, জেলার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১১৩ জন ও বিসিআইসির ৪৭ জন ডিলারকে জুলাই মাসে ৩ হাজার ৪৩৭ টন ইউরিয়া, ১ হাজার ৮৬ টন টিএসপি, ১ হাজার ১৫০ টন ডিএপি ও ১ হাজার ২০৬ টন এমওপি বরাদ্দ দেয়া হয়, যা চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
চলতি আমন মৌসুমের এক মাস পেরিয়ে গেলেও চাষাবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫০ শতাংশ। কয়েক মাস ধরে এই সংকট চললেও কৃষি বিভাগের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি বলে অভিযোগ কৃষকদের। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমন চাষাবাদ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এমন পরিস্থিতির জন্য সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যকে দায়ী বলে মনে করেন সদর উপজেলার অমরখানা এলাকার কৃষক শরিফ মিঞা। বলেন, ‘যখনই আমরা আমন চাষাবাদ শুরু করি, তখনই শুরু হয় সার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। বেশি দাম দিলেই আবার সার পাওয়া যায়।’
এক প্রকার বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত দামে তাদের সার কিনতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সার পাইনি। প্রতিবাদ করতে গেলেই বলে সার নেই। নিরুপায় হয়ে আমাদের অতিরিক্ত দাম দিয়ে সার কিনে জমিতে দিতে হচ্ছে। বিষয়টি দেখার কেউ নেই।’
ক্ষোভে আমন চাষই বন্ধ করে দিয়েছেন একই এলাকার কৃষক মহসিন আলী। বলেন, ‘প্রতি বছর সারের এই সংকট তৈরি হলেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বারবার হয়রানির শিকার হচ্ছি আমরা। তাই এবার আমন চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছি।’
কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ডিলারদের কাছে গেলে তারা বলে সার নেই। আবার অতিরিক্ত টাকা দিলেই সার বের হচ্ছে। এভাবে পকেট কাটা যাচ্ছে আমাদের, আর লাভ করছেন ডিলাররা।’
জেলার কিছু ডিলার এই সিন্ডিকেটের হোতা বলে দাবি করেছেন এক খুচরা সার বিক্রেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সার বিক্রেতা বলেন, ‘পঞ্চগড়ের বড় কয়েকজন ডিলারই এই সিন্ডিকেটের হোতা। তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের নামে একাধিক লাইসেন্স করে সার উত্তোলন করে বেশি দরে বিক্রি করছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে কিনে বস্তায় ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করছি মাত্র।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ডিলার বলেন, ‘পঞ্চগড়ে চাহিদার অর্ধেকও সার পাওয়া যাচ্ছে না। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি কৃষি বিভাগ গোপন করছে।’ তারা সঠিক জায়গায় এই সংকটের কথা তুলে ধরছে না বলে মনে করেন তিনি।
পঞ্চগড় ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘জেলায় আমনের সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সার চলে যাচ্ছে চা চাষিদের কাছে। চায়ের জন্য সার বরাদ্দ নেই। তাই এই সংকট দেখা দিয়েছে।
‘সার যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, তা দিয়ে আমরা কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। আমরা ডিলাররা যে পরিমাণ বরাদ্দ পাচ্ছি, তা সরকার নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করা হচ্ছে। বাইরে থেকে যারা কিনে এনে বিক্রি করছেন, তারা বেশি দাম নিচ্ছেন।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত চাষাবাদ হয়েছে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। এ মাসেই আগস্ট মাসের সারের বরাদ্দ চলে এসেছে। এ ছাড়া আমরা অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছি।’
সারের সংকট হবে না- এমন আশা পোষণ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা বিষয়টি মনিটর করছেন। কেউ অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’