মোস্তুফা কামাল:
আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল সরকারি অর্থব্যবস্থা এবং করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এতে লঙ্কান সরকারের অন্যতম রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনশিল্প ধসে পড়েছে, বিদেশি রেমিট্যান্স পৌঁছেছে তলানিতে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় দেশটিকে তিলে তিলে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে এসেছে।
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ২ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপর্যন্ত জনজীবন। গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি বেশ টালমাটাল ছিল। এই অবস্থায় দেশের বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। ২০২০ সালে শুরুর দুই মাসে রিজার্ভ ৭০ শতাংশ কমে যায়। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে বিদেশি মুদার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২.৩ বিলিয়ন ডলারে! শুধু তা-ই না, বছরের বাকি সময়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতে হয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকারকে।
ksrm
ksrm
কিন্তু ২০২০ সালের শুরু হতে বিশ্বব্যাপী অতিমারী করোনা সংক্রমণ দেশটির পর্যটন শিল্প একেবারে ধসিয়ে দেয়। অর্গানিক চাষের জন্য দেশের খাদ্য উৎপাদন ২০% কমে যায়। ফলে প্রচুর আমদানি করতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার যোগান কমে। অতি প্রয়োজনীয় পেট্রোলিয়াম আর প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমাতে হয়। এভাবে চলতে চলতে গত মার্চ ২০২২ হতে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যে পেট্রোলিয়াম আর গ্যাসের বরাদ্দ জনগনের জন্য ক্রমান্বয়ে ২৭ জুন ২০২২ শুন্যে নেমে আসে। কাগজের আমদানি বন্ধ থাকায় ছাত্রদের পাবলিক পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। বিক্ষোভে জনগণ পথে নেমে আসে।
১ এপ্রিল ২০২২জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রধানমন্ত্রী। ৩ এপ্রিল ২০২২ মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে । ১২ এপ্রিল শ্রীলংকা নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করে। ০৯ মে সহিংসতার পর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ২৭ জুন সব জ্বালানি বিক্রি বন্ধ করে শ্রীলংকা সরকার। তারা জানায় তাদের কাছে প্রয়োজনীয় জ্বালানি নেই। ১ জুলাই শ্রীলংকায় রেকর্ড মূল্যস্ফীতি ঘটে। ০৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পলায়ন করেন। নানা ঘটনার মধ্যে তিনি মালদ্বীপ হয়ে সিঙ্গাপুর যান এবং ১৩ জুলাই সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে ইমেইল করে পদত্যাগ করেন।
একদিনের ঘটনা নয়
দাতা দেশ ও সংস্থা গুলোর ঋণ পরিশোধে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায়। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ঔষধ সংকট ছাড়াও বিদ্যুৎহীনতার মধ্যেই কাটছে দিনের বেশিরভাগ সময়। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ইন্দ্রজিত কুমারস্বামী বলেছেন, শ্রীলংকার এ সংকট হুট করে জন্ম হয়নি বরং এ সংকটের উৎসের দিকে তাকাতে হলে অনেক আগে ফিরে যেতে হবে সেই পঞ্চাশের দশকে। তার মতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে দেশটির অর্থনীতি কখনোই নিরাপদ থাকার মতো স্থিতিশীলতা পায়নি। গত কয়েক বছরে এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। শ্রীলংকার কখনই শৃঙ্খলাপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছিলো না। ফলে অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিকভাবে প্রবল আকার ধারণ করেছে। শাসন ছিল জনতুষ্টিবাদী সস্তা রাজনীতির আর ভাগ বাটোয়ারা সংস্কৃতির একটা দূষিত সমন্বয়। কিন্তু পুরো বিষয়টি বাজার ব্যবস্থার উপর নির্ভিরশীল যারসাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ডিসিপ্লিনড হওয়ার দরকার ছিলো। কিন্তু তা না হয়ে নিয়মিত বার্ষিক বাজেট ঘাটতির কারণে রাজস্ব কমেছে নাটকীয়ভাবে; কমেছে রপ্তানি আর বেড়েছে ঘাটতি। আর এটি গত ২০ বৎসরে ব্যাপক হয়েছে।
দায়ী উন্নয়নের রাজনীতি
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখন’ একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়েছে – উন্নয়নের রাজনীতি। কোন কোন দেশ আরেকটু অগ্রসর; তারা বলছে – কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। এই স্লোগানকে সম্বল করে অনেক দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পুরোপুরি স্বৈরাচারী শাসন কায়েমে ব্যস্ত। উন্নয়ন এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে যে, দেশগুলোতে মৌলিক মানবাধিকার ক্রমাগত লংঘিত হচ্ছে। একদলীয় শাসন জেঁকে বসছে। কোথাও পরিবারতন্ত্র কায়েম হচ্ছে। আর এই সমস্ত দেশে অপ্রয়োজনীয় আর চাকচিক্যময় প্রকল্প গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি এমন ভাবে শিকড় গেড়ে বসছে যে তা দেশটির জন্য শেষ বিচারে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শ্রীলংকার বিষয়টি এরকমই। দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বিবিসি মোটা দাগে ছয়টি কারণকে চিহ্নিত করেছে:
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প: গত ২০ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে – সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা আর নতুন শহর তৈরী ইত্যাদি । রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে।যার বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। এসব প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। শ্রীলংকা গত এক দশকে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে।
ঋণের ভারে জর্জরিত: বিগত ২০ বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। এর মধ্যে অন্যতম উৎস্য হচ্ছে সার্বভৌম বন্ড। কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি।
ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা: আন্তর্জাতিক সার্বভৈৗম বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋন রয়েছে এখন সাড়ে বারো বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে চলতি বছর শ্রীলংকাকে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চলতি বছর এসব ঋণ শোধ করতে পারছে না দেশটি। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে- ফলে দেশটি জ্বালানী তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না।
কর কমানো: দুই হাজার উনিশ সালের নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হবার পরে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট দেশটিতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর জনতুষ্টিমূলক সিদ্ধান্ত নেন। আয়কর এবং ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে সরকার আরো ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতের বিপর্যয়: শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রার বড় জোগান আসে দেশটির পর্যটন খাত থেকে। এর অন্যতম যোগানদাতা চীন, রাশিয়া আর ইউক্রেন। করোনাভাইরাস মাহারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটি।
অর্গানিক চাষে বিপর্যয়: ক্ষমতাসীন হবার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একসময় শ্রীলংকা বাধ্য হয় ৪৫০মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল দেশটির চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে আনার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়।
অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব “প্রোভার্টি এন্ড ফেমিনস”
অমর্ত্য সেন তার “প্রোভার্টি এন্ড ফেমিনস” লেখায় দেখিয়েছেন সামাজিক অস্থিরতা এবং দুর্ভিক্ষ শুধু খাদ্যের অভাবেই হয় না; সম্পদের অসম বণ্টন এবং সমাজের অসমতা থেকেও সৃষ্টি হয় সামাজিক অস্থিরতা এবং দুর্ভিক্ষ। উদাহরণ – ১৯৪৩ বাংলাদেশে তথা তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেটাও খাদ্য ঘাটতির জন্য হয়নি, হয়েছে সামাজিক অসামঞ্জস্যতার কারণে এবং সম্পদের সুসম বণ্টনের অভাবে। অমর্ত্য সেন তার বইয়ে তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন সে সময় বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। সেসময় খাদ্য-শস্য মজুদ এবং সরবরাহ ছিল এক শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ; যেমন মিলিটারি, সরকারের তল্পিবাহক, অলিগার্ক, মজুতদার এবং অতি মুনাফাখোর। ফলে দৈনন্দিন জিনিস পত্রের ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যদ্রব্য বাংলার ভূমিহীন কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, মুচিসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় । ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা যায় । অমর্ত্য সেন সেই সত্যকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে যে “গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন” কতটা প্রয়োজনীয় একটা দেশ এবং জাতির জন্য। শুধু উন্নয়ন দিয়ে দেশ বা জাতি রক্ষা করা যায় না। আজকের শ্রীলংকা এই সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার পার্থক্য
মূলত যে কারণে শ্রীলঙ্কার আজ দেউলিয়া অবস্থা, তা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। এর অনেকাংশই ব্যয় হয়েছে উচ্চাভিলাষী অতিমূল্যায়িত বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে (সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ইত্যাদি), যেগুলো থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল আসেনি। এসবের কোনোটিই বাংলাদেশের সঙ্গে তেমন মেলে না। মূল্যস্ফীতি আছে, তবে তা শ্রীলঙ্কার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রেমিট্যান্স-প্রবাহ এখন পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক আছে। কৃষি ও রপ্তানি খাত ভালো করছে। পর্যটন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো আছে স্বস্তিদায়ক পর্যায়েই।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে, তবে মেগা প্রকল্পের জ্বরে আক্রান্ত বাংলাদেশও। এর অনেকগুলো প্রকল্পই উন্নয়ন যাত্রায় প্রয়োজনীয় ও উপকারী। তবে এটা সবাই মানেন যে এশিয়ার অন্যান্য দেশে একই ধরনের প্রকল্পের তুলনায়, আমাদের অধিকাংশ প্রকল্পই অতিমূল্যায়িত। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায়ই যে অর্থমূল্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা করা হয়, প্রকল্প সমাপ্তিতে তার ব্যয় দাঁড়ায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া সব প্রকল্পই যে প্রয়োজনীয় বা ভালো তা-ও নয়। ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু হয়ে রেললাইন প্রকল্প, কক্সবাজার রামু রেল প্রকল্প, পায়রা বন্দর ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রথম ২৫ টি অর্থনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ
ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত ডজনখানেক উন্নয়নশীল দেশ। দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানও আছে। এই অঞ্চলেরই সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো সংকটে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরো ১৩ টি দেশ আছে এই তালিকায়। এই ডেঞ্জার জোনে থাকা দেশগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে পাকিস্তান। অক্ষমতার তালিকায় ইতোমধ্যেই লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জাম্বিয়া জায়গা করে নিয়েছে। ঋণ সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বেলারুশসহ কমপক্ষে ডজনখানেক দেশ। তবে এই ঝুঁকির তালিকায় নেই বাংলাদেশ।
তবে আইএমএফ কর্তৃক করোনা পরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ ৬০ টি দেশের মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশের (গ্রীস, স্পেন ইত্যাদি) সাথে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা এখনো আশা ছাড়েননি। তারা বলছেন, যদি বিশ্ববাজার শান্ত হয়ে আসে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বেশ কিছু সমর্থন পাওয়া যায় তবে হয়তো কিছু দেশ খেলাপি হওয়া এড়িয়ে যেতে পারবে।
বাংলাদেশও উন্নয়নের রাজনীতির পথে হাঁটছে
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর খরচবহুল উদ্বোধন হয়ে ২৫ জুন ২০২২। দক্ষিণ বঙ্গের ২১ টি জেলার দ্বার উন্মোচিত হল। করোনা সংকট কাটিয়ে পুরোদমে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পগুলো। সরকার আগামী বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর পরিকল্পনা করেছে। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প চালু হওয়ার পাশাপাশি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের একটি ইউনিট ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে উৎপাদনে যেতে পারে। ৮টি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে ৪টির কাজ শেষ হওয়ার পথে। ফলে, নতুন বাজেটে সেসব প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কিছু প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের অর্থ পরিশোধ শুরু হবে। কাজেই, এখন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মেগা স্ট্রাকচারগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজের গতি বাড়াতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য রেকর্ড ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা মহামারির প্রভাবে দেশ সংকটের মুখে রয়েছে। প্রস্তাবিত এডিপি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।
দরকার গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন
অমর্ত্য সেন সেই সত্যকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে যে “গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন” কতটা প্রয়োজনীয় একটা দেশ এবং জাতির জন্য। শুধু উন্নয়ন দিয়ে দেশ বা জাতি রক্ষা করা যায় না। আজকের শ্রীলংকা এই সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে। মাহিন্দা রাজাপাক্সে একটা পরিবার কেন্দ্রিক সরকার গঠন করে বহুদিন ধরে দেশ চালাচ্ছিল। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে অলিগার্ক বা কিছু লোকের পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা এবং তারাই রাজাপাকসে ও শ্রীলংকার বারোটা বাজিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত – সেটা ক্ষমতাসীন এবং প্রধান বিরোধীদলগুলোতে। উন্নয়নের রাজনীতি বাস্তবায়নে প্রধান দলগুলোর ভূমিকা এক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর একক নেতৃত্বে দেশকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তৃতীয় বিশ্বে বাংলাদেশ একটি রোলমডেল। মেগা প্রকল্পগুলো ক্রমান্বয়ে চালু হচ্ছে এবং এর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে সংযুক্ত হচ্ছে।
কিন্তু শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রহীনতা আর আধিপত্যবাদীতা এই সমস্ত প্রকল্পে জনগণকে সম্পৃক্ত করছে না। তাই এগুলোর রক্ষনাবেক্ষন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলে ফেলার ঘটনা আরো বড় কোন দুর্ঘটনার ইঙ্গিত বহন করে।
দরকার টেকসই উন্নয়ন
বর্তমান সময় পরিবেশ আর জলবায়ু বিপর্যয় একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। একে পাশ কাটিয়ে কোন প্রকল্প নেয়াটা সময়ের বিবেচনায় অর্থের অপচয়। বাংলাদেশের অনেকগুলো প্রকল্প প্রকৃতি-পরিবেশ বিরোধী। যেমন – সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠছে কয়লা ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি বাংলাদেশের ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবন ধ্বংস করে দেবে। এমনি আরেকটি মহেশখালী দ্বীপের কয়লা ভিত্তিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা দ্বীপটির অস্তিত্ব বিলীন করে দেবে। এরই কাছাকাছি আরেকটি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এমনটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও পরিবেশ বিপর্যয়ের আরেকটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
বর্তমানে প্রকৃতি-পরিবেশ বিরোধী কোন প্রকল্প টেকসই হবে না। হয় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য – নয়ত উন্নত বিশ্বের প্রবল চাপে তা বন্ধ করতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। ফলে এই ব্যাপক অর্থ যা ঋণ করে আনতে হচ্ছে তার সুদের মাসুল গুনতে হবে।
দরকার উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহন
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ হাজার মেগাওয়াট সামর্থ অর্জনের উৎযাপন করেছে বাংলাদেশ। বর্তমান সামর্থ্য ক্যাপটিভ সহ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সহ ২৫,৫৬৬ মেগাওয়াট। কিন্তু এ মাসের প্রথম হতে যে পরিমান লোডশেডিং সারা দেশের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে তাতে এটা স্পষ্ট যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো পরিকল্পনা হয় বাস্তবতা বর্জিত নয় বিশেষ কোন গোষ্ঠীর স্বার্থে। তাইতো দেশের নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রগুলোকে সার্ভিসিং না করে ওপেন মার্কেট থেকে বেশ কয়েকগুন বেশি টাকা দিয়ে গ্যাস কিনে নিজেদের পকেট ভারী করছে কিছু লোভী-স্বার্থপর। যেখানে ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করলে আমাদের শতভাগ বিদ্যুৎ নিজেদের গ্যাস হতে উৎপাদন করা যায় সেখানে ওপেন মার্কেট হতে কেনাটা একটি দেশ-স্বার্থবিরোধী কাজ। আর এটি হতে পারছে কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার সাথে জনগণের কোন অংশগ্রহন নেই। তার আরেকটি প্রতিদিনকার ঘটনা সিস্টেম লস (বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার সেল এর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ এর জুন মাসের সিস্টেম লস ৮.৪৮%)।
দরকার অর্থনৈতিক একচেটিয়ার অপসারণ
যেকোন জনগণ অসম্পৃক্ত শাসনের প্রধান প্রবণতা হয়ে উঠে একচেটিয়ার প্রাধান্য। এর প্রথম লক্ষণ হিসেবে ব্যবসায় একচেটিয়া। ফলে কোন দ্রব্য বা সেবার মূল্য বাড়ে অস্বাভাবিক হারে। আমাদের বিদ্যুৎ মূল্য বৃদ্ধি এর একটি উদাহরণ। প্রতি বৎসর এর মূল্য বাড়তে বাড়তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এরকমটি দেশের প্রতিটি স্তরে। পদ্মা সেতু চালু হওয়া দক্ষিণ বঙ্গের ২১ টি জেলার মানুষের প্রাণের দাবি পূরণ। কিন্তু সেতুটি চালু হওয়ার কারণে বাস ভাড়া ন্যূনতম দ্বিগুন হয়ে গেছে। এটিও জনসম্পৃক্তহীন এবং একচেটিয়ার আরেকটি উদাহরণ।
কোন জনগাষ্ঠীকে সত্যিকার উন্নয়নে সামিল করে তার সুফল পেতে ব্যবসায় একচেটিয়া দূর করা আবশ্যক। এর অন্যথা উন্নয়নের সুফল সেই জনগোষ্ঠী পায় না। বরং একচেটিয়া ব্যবসা তার সবটুকু শুষে নেয়। অনেক সময় সেই উন্নয়ন আর তার শাসকরা জনরোষের সম্মুখহীন হয়।
দরকার জিরো মার্জিনাল সোসাইটি গঠন
সামাজিক তাত্ত্বিক জেরেমি রিফকিনের মতে, দ্য ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বোধকে ক্ষুণ্ন করবে, আমাদের চাকরি কেড়ে নেবে এবং একটি নতুন বৈশ্বিক “শেয়ারিং ইকোনমিতে” আমাদেরকে ফ্রি এজেন্টে পরিণত করবে, ২১ শতকের মাঝামাঝি আগে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করবে।
এমন যন্ত্রের কথা চিন্তা করুন যারা -প্রতিলিপি তৈরি করবে এবং একটি বিকল্প শক্তির উত্স দ্বারা চালিত হবে। তারা আসন্ন “ইন্টারনেট অফ থিংস” দ্বারা সংযুক্ত হবে, একটি স্ব-সংগঠিত নেটওয়ার্ক যা তাদের একটি নতুন বিস্তৃত বুদ্ধিমান অবকাঠামোর অংশ হিসাবে কাজ করার অনুমতি দেবে। এই তড়িচ্চুম্বকিয় যন্ত্রগুলো সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হবে এবং পরিচালনার জন্য কোনও মানব শ্রমের প্রয়োজন হবে না। ফলস্বরূপ, তারা কার্যত কোন খরচ ছাড়াই পণ্য উৎপাদন করবে।
রিফকিন তিনটি ভবিষ্যৎবাণী করেন:
প্রথমটি “শেয়ারিং ইকোনমি” (মনে করুন Airbnb-এ আপনার অতিরিক্ত ঘর ছেড়ে দেওয়া বা Uber-এ একটি গাড়ি তলব করা) যা বৃহৎ পুঁজির বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেবে।
দ্বিতীয়টি বিকল্প শক্তির উত্সগুলির একটি বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্ক বিদ্যমান উল্লম্বভাবে সমন্বিত, কার্বন-ভিত্তিক শক্তি শিল্পকে প্রতিস্থাপন করবে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ, রিফকিন বলেছেন, ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ এইভাবে তৈরি হবে – এটি তার ভাষায় একটি অতি রক্ষণশীল হিসেবে।
তৃতীয়টি হল কাজ বাদ দেওয়া, যেহেতু যন্ত্রগুলো কাজের স্থান দখল করে নেয়। রিফকিনের মতে, আগামী ৪০ বৎসরের মধ্যে শ্রমের ইতিহাসের সমাপ্তি হবে।
জেরেমি রিফকিন এই শতকের মধ্যে প্রযুক্তিগত উন্নতি মানুষকে যেভাবে একটি অমিত সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করছে তার বর্ণনা করেছেন তার “দ্য জিরো মার্জিনাল কস্ট সোসাইটি: দ্য ইন্টারনেট অফ থিংস, দ্য কোলাবোরেটিভ কমন্স এবং দ্য ইক্লিপস অফ ক্যাপিটালিজম” লেখায়। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে আমাদের অভিযোজন আর সহাবস্থান প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য দুটি মৌলিক জিনিসের উপস্থিতি আবশ্যক: প্রথমটি – গণতন্ত্রের উপস্থিতি; আর দ্বিতীয়টি – গণমানুষের সক্রিয় অংশগ্রহন। এর মাধ্যমেই জিরো মার্জিনাল সমাজ গঠন করা সম্ভব। এটিই হবে আগামীর বাংলাদেশকে স্থায়িত্বশীল করার একটি কার্যকরী উপায়।
লেখক: লায়ন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা কামাল,
গভর্নর, লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল।